Search This Blog

Thursday, July 23, 2015

আমরা বাঙালীরা ক্যাজুয়্যাল বর্ণবাদী !

বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম গত এক বছর ধরে অভাবনীয় সাফল্যের সাথে খেলে নিজেদেরকে বিশ্বের প্রথম সারির একটা দলে পরিণত করেছে। সাফল্যের পথ বেয়ে আসে নানা অবাঞ্চিত জঞ্জাল, আত্মঅহমিকার তোড়ে অনেক সময় সরে যায় মানবিকতার মুখোশ, আর বেরিয়ে আসে আমাদের আসল চরিত্র। বাংলাদেশ বনাম সাউথ আফ্রিকার মধ্যকার প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্ন বিরতিতে কিছু দর্শক ডেল স্টেইনকে মৌখিক অপমান করার পাশাপাশি তার গায়ে মার্বেল ছুড়ে মেরেছে। বিপক্ষের এক জন খেলোয়াড়ের সাথে এমন আচরণ ভব্যতার সব মাপকাঠিই ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশি দর্শকেরা এখানেই থেমে যায়নি, তারা ডেল স্টেইনের সংগী একজন "কৃষ্ণাংগ" খেলোয়াড়কে উদ্দেশ্য করে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছে, যার মধ্যে আছে N আদ্যাক্ষরের অপমানসূচক শব্দ। দক্ষিণ আফ্রিকা দল এর প্রতিবাদ জানিয়েছে, ম্যাচ রেফারি আরেক বার এমন ঘটনা ঘটলে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন।
আমাদের বর্ণবাদ শুধু বিদেশীদের উদ্দেশ্যেই তা কিন্তু নয়। আমরা নিজ পরিবারের তুলনামূলক গাঢ় বর্ণের সদস্যটিকে সরাসরি কিংবা নানা রূপকের আশ্রয় নিয়ে অপমান করি। আমাদের মা বাবা সন্তানের গাত্রবর্ণের লজ্জা ঢাকতে “উজ্জ্বল শ্যামলা”’র মত ছদ্মবেশী শব্দের ব্যবহারে বাধ্য হোন। গায়ের রঙের গাঢ়ত্বের জন্য আমাদের সমাজে অনেককে পিছিয়ে পড়তে হয় শিক্ষা, চাকুরী, বিয়ে জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে। আমরা নানা জেলার লোকেদের সম্পর্কে একগাঁদা স্টেরিওটাইপ দাঁড় করিয়ে রেখে, তাদের সাথে মেলামেশায় সেটা প্রয়োগ করি। ছোট্ট একটা বদ্বীপে বাস করে এক জেলার লোক অন্য জেলার লোকের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে চাই না, অন্যরা আমাদের মত যথেষ্ট ভালো না বলে।
আমি জানি না অন্যদের অভিজ্ঞতায় কী বলে, কিন্তু নিজ দেশবাসীদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা যা হয়েছে, তা থেকে বলতে পারি, আমাদের মাঝে বর্ণবাদ মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। কেউ সচেতনে, কেউ অচেতনে বর্ণবাদী আচরণ করে। আমরা অনেকে জানি না যে শব্দেরও রাজনীতি আছে, ইতিহাস আছে। অনেকে আমাদের “ক্যাজুয়াল” বর্ণবাদী মন্তব্যে অন্যে কতটা আঘাত পাবে সেটা চিন্তা করতেই অপারগ। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূত্রে ভিতরের অন্ধকার যখন বেরিয়েই এসেছে, আমাদের উচিত এ নিয়ে খোলামেলা কথা বলা। আমাদের উচিত নিজেদের অন্ধকারের মোকাবেলা করে নিজেকে ভালোমত চেনা। বর্ণবাদ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা হওয়া খুবই জরুরী। মানুষকে সচেতন হতে হবে যে গায়ের রঙের উপর নির্ভর করে একটা মানুষ আলাদা হয়ে যায় না। তাদেরকে জানাতে হবে কোন ধরনের আচরণ বর্ণবাদী। জানতে হবে অতীতের বর্ণবাদ কীভাবে মানবসমাজের একটা বড় অংশকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ হিসাবে প্রাপ্য সব অধিকার বর্জন করে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়েছে। প্রাসঙ্গিক জ্ঞান থেকেই আসবে নিজের থেকে আলাদা দেখতে মানুষের প্রতি সহমর্মিতা।
মিডিয়াগুলোর উচিত যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এই ঘটনার প্রচার করা। ভেতরের পাতায় ছোট করে এ সংবাদ ছাপিয়ে দেশের সংবাদপত্র তাদের দায় মিটিয়ে ফেলতে পারে না। বিসিবির প্রতি দাবী জানাই তারা যেন এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে দর্শকদের জন্য একটা গাইডলাইন তৈরী এবং সেটা প্রয়োগ করে। আন্তর্জাতিক নানা ক্ষেত্রেতো আমাদের ভুগতে হবেই, স্বদেশীদের প্রতিও আমরা দিন দিন আরো নির্দয় হয়ে দেখা দিব। বর্ণবাদ আমাদের দেশে শৈশবে নয়, বরং কৈশোরকাল অতিক্রম করছে। সেটা এখনি দূর করব কিনা এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে আমরা ভবিষ্যতের আমাদেরকে মানবতা থেকে কত দূরে রেখে গড়ে তুলব।
হিউমিনিটির ক্র্যাডল আফ্রিকা থেকে নানা সময়ে, নানা পথে মাইগ্রেট করে মানুষ পৌঁছেছে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ আর অ্যামেরিকাতে। হাজার হাজার বছর স্থায়ী এইসব মাইগ্রেশনে মানুষের নানা গোষ্ঠীকে অভিযোজিত হতে হয়েছে সূর্যের ভিন্ন পরিমাণ আলোর নীচে (আরো সঠিকভাবে বিভিন্ন পরিমাণ অতিবেগুনী রশ্মির উপস্থিতিতে )। আফ্রিকার গনগনে সূর্যের নীচে অভিযোজিত হওয়া মানুষের ত্বকে অতিবেগুনী রশ্মিকে ঠেকানোর জন্য দায়ী মেলানিনের প্রাচুর্য্য, আবার বছরের বড় সময় ধরে বিরল সূর্যের নীচে অভিযোজিত হওয়া ককেশিয়ানদের ত্বকে মেলানিনের স্বল্পতা যেন তারা যথেষ্ট পরিমাণ সূর্যোলোক পেতে পারে। মাঝারি সূর্যের নীচে অভিযোজিত হওয়া মানবগোষ্ঠীর গায়ের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ মাঝারি। মেলানিনের পরিমাণ গায়ের রঙ্গের গাঢ়ত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আর তাই আফ্রিকার লোক কৃষ্ণাংগ, ককেসিয়ানরা শ্বেতাংগ। আর এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি জায়গার লোকেদের গায়ের রঙ “বাদামী” থেকে “হলুদ”। গায়ের রঙ বিবর্তনের লম্বা ইতিহাসে, মানব শরীরের নিরাপত্তায় গড় উঠা অতি বেগুনী রশ্মি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার একটা বাইপ্রোডাক্ট মাত্র। মানুষের অর্জন কিংবা তার অন্তর্নিহিত মনুষত্বের কোন পরিমাপক এটা নয়।

No comments:

Post a Comment